রসুন অবশ্যই একটি উপকারী ভেষজ উপাদান। রসুন প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে মসলা বা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। বর্তমানে রসুনকে বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ম্যাজিকের মত কাজ করে এক কোয়া রসুন। রসুনের গুনাগুন জানলে চমকে যাবেন আপনিও। রসুন খাওয়ার উপকারিতা। Benefits of eating garlic in Bangali language. কাঁচা রসুন খেলে কি হয়, কাঁচা রসুন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা, খালি পেটে রসুন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
প্রত্যেকদিন সকালে এক কোয়া রসুন খাওয়া কেন স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী?
- রসুনের এত উপকারিতা যে রসুনকে মর্তের অমৃত বলা হয়।
- রসুনের বিজ্ঞানসম্মত নাম Allium Sativum ।
- রসুন দুই রকমের পাওয়া যায়। প্রথমটি হল, এক কোয়াবিশিষ্ট রসুন। তবে এই রসুনের দাম অনেক বেশি। দ্বিতীয়টি হল, বহু কোয়া বিশিষ্ট রসুন। এটি সহজলভ্য। এর দামও কম। তবে এর গন্ধটা একটু বেশি ঝাঁঝালো।
রসুনের উপকারিতা:
১. ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে রসুন।
সুগার হল একগুচ্ছ রোগের সমাহার। এই রোগের ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। ইনসুলিনের অসম ক্ষরণের ফলে মূলত এই রোগ হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন রসুনের মধ্যে অ্যালিসিন নামক একটি কম্পাউন্ড থাকে। যা ইনসুলিন এর ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। তার ফলের সুগার কমে খুব সহজে।
এক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে দুই থেকে তিন কোয়া রসুন খেতে হবে। চিবিয়ে খেতে না পারলে কুচি কুচি করে গিলে খেতে পারেন।
২. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে।
আপনার LDL কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে সে ক্ষেত্রে সারা জীবনের জন্য কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে প্রতিদিন দুই কোয়া করে রসুন খালি পেটে চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করুন। মাঝে মাঝে দু একদিন বাদ গেলেও ক্ষতি নেই। রসুন LDL ও টাই গ্লিসারীড কমাতে সাহায্য করে।
HDL বাড়াতে সাহায্য করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে রসুন লিভারের কোলেস্টেরল এর সংশ্লেষ কমিয়ে দেয়। এবং কোলেস্টেরল কে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
৩. হৃদরোগের সম্ভাবনা কমায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, বিশ্বের মৃত্যুর সর্ববিরোধ কারণ হলো হৃদরোগ। ২০১১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৭.৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় হৃদরোগে।
তার ৮০% মানুষ হলো উন্নতশীল দেশের মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী ২০৩০ সালে ২৩.৬ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারাতে পারেন হৃদরোগে। তাই আপনার হৃদযন্ত্র কে সুস্থ রাখতে প্রতিদিন সকালে দুই কোয়া করে রসুন খেতে পারেন।
কারণ রসুনের মধ্যে সালফার ও মনো-সালফার বাই একটিভ মিশ্রণ থাকে যা হৃদরোগের প্রতিরোধ করতে পারে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুযায়ী রসুন অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মায়োকারডিয়ামের দুর্বলতা, অ্যাথেরোক্লোরোসিস প্রভৃতি রোগে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে হৃদ রোগের ঝুঁকি কমায়।
৪. প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রেসার বলতে এখানে হাই প্রেসার বা হাইপার নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে ১৩.৫% মানুষ মারা যায় উচ্চ রক্তচাপে।
অতি সম্প্রতি চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী কুড়িটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে রসুনকে একটি উত্তম হাই ব্লাড প্রেসারের ওষুধ তুলে ধরা হয়েছে।
তবে রোগটি প্রবল আকারে দেখা দেওয়ার পর রসুন খাওয়া আরম্ভ করলে পারদের মাত্রা তর্ তর্ করে নিচের দিকে নেমে যাবে, সে আশা করবেন না।
অন্য ওষুধ চলবে ব্লাড প্রেসারের সাংঘাতিক অবস্থাকে কন্ট্রোল করার জন্য। সেই সঙ্গে রসুন খেতে হবে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে।
দুই থেকে তিন কোয়া রসুন চিবিয়ে খেতে পারেন। চিবিয়ে খেতে না পারলে কুচিকুচি করে কেটে গিলে খেতে পারেন। হাই ব্লাড প্রেসার ভালো হবে আয়ত্তে আসার পর, কেবলমাত্র রসুন খেয়ে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
৫.প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে খালি পেটে রসুন খেলে তার শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। তাই আপনার দেহে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে দূর করতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে দুই কোয়া রসুন খেতে পারেন। যা ম্যাজিকের মত আপনার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করবে।
৬. যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে।
পুরুষের যৌন অক্ষমতার ক্ষেত্রে রসুন খুব ভালো ফল দিয়ে থাকে। যৌন ইচ্ছা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার খুব কার্যকারী। কোন রোগের কারণে বা কোন দুর্ঘটনার কারণে বা আপনার বয়সের কারণে যৌন ইচ্ছা কমে গেলে এটি আপনাকে তা ফিরে পেতে সাহায্য করে।
রসুন আপনার দেহের টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। আর টেস্টোটেরন man sex হরমোন নামে পরিচিত। আমাদের বাহ্যিক খাদ্য অভ্যাস, ধূমপান, অ্যালকোহল, অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন ও শারীরিক পরিশ্রমের কারণে দিন দিন হেলদি শুক্রানুর পরিমাণ কমে যেতে পারে।
সে ক্ষেত্রে হেলদি শুক্রাণু তৈরিতে রসুন এর জুড়ি মেলা ভার। তাই প্রতিদিন সকালে খালি পেটে দুই থেকে তিন কোয়া রসুন খেলে আপনার যৌন অক্ষমতা দূর হবে। যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
৭. আমবাত নিয়ন্ত্রণ করে।
যদি আপনার গাঁটে-গাঁটে ব্যথা, সকালের দিকে হাত- পায়ের আঙুলে আড়ষ্ট ভাব সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে প্রতিদিন দুই থেকে চারকোয়ার রসুন খাওয়ার অভ্যাস করুন।
রসুন কুচি কুচি করে কেটে প্লেটে রাখুন ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর সেগুলিকে খালি পেটে চিবিয়ে খেয়ে নিন। তার ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর জলখাবার খেয়ে নিতে পারেন। আর এতে যদি কারোর অসুবিধে হয় তাহলে খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিট পর রসুন গিলে খেয়ে নিন।
এছাড়াও গাঁটে গাঁটে ব্যথা ও যন্ত্রণার উপশমের জন্য রসুনের তেল লাগাতে পারেন।
৮. দাঁতের যন্ত্রণা কমায়।
দাঁতের যন্ত্রণা কমাতে রসুন বেশ কার্যকারী। রসুন খেত করে দাঁতের গোড়ায় লাগিয়ে হালকাভাবে মাসাজ পড়লে উপকার পাওয়া যায়। আর হঠাৎ করে যদি দাঁতের যন্ত্রণা দেখা দেয় বা মাড়ি ফুলে যায়। তাহলে এক কোয়া রসুন চিবিয়ে দাঁতের গোড়ায় লাগিয়ে রাখুন। ৩০ মিনিট পর থেকে যন্ত্রণা ও ব্যথা কমতে থাকবে। এছাড়াও পাইরিয়া সারাতে রসুন ভালো কাজ করে।
৯. যক্ষ্মা নিরাময় করে।
যক্ষ্মা রোগের অত্যাধুনিক ওষুধ বারবার ব্যবহার হচ্ছে বারবার ভালো হচ্ছে কিন্তু রোগী আবার যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় ওষুধ আর কাজ দিচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে।
এরকম ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে রসুন খাওয়া যেতে পারে। এরপর রোগ সারলে আবার রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। এক্ষেত্রে রসুনের রস ১৫ থেকে ২০ ফোটা জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিনে তিন থেকে চারবার খাওয়ানো যেতে পারে।
১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
বর্তমান সময়ে বহু মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। পুরুষ ও মহিলাদের ক্যান্সার দিন দিন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। সে ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে রসুন ক্যান্সারের প্রতিরোধ কোষ কে বৃদ্ধি করে। নিয়মিত রসুন খেলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।
রসুন ঠোঁট, মুখ, পরিপাকতন্ত্র, স্তন, ফুসফুস ও জরায়ু মুখ প্রভৃতি ক্যান্সারে ভালো কাজ করে। কারণ রসুন ক্যান্সার কোষের বিভাজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এছাড়াও রসুনের শক্তিশালী আন্টি- অক্সিডাইড থাকায় শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর ফ্রি রেটিকেল কোষগুলিকে ধ্বংস করে।
১১. চোখ ভালো রাখে।
চোখের পক্ষে রসুন খাওয়া খুব ভালো। কারণ কাঁচা রসুন খেলে চোখের ছানি কেটে যায়।
১২. সর্দি কাশির জন্য রসুন ভালো।
যাদের অনেকদিন ধরে সর্দি লেগে আছে কমছে না, বুকে কফ বসে আছে, ছাড়ছে না, তো তাদের জন্য রসুন খুবই উপকার দেবে।
রসুনের অপকারিতা:
১. গর্ভাবস্থায় কাঁচা রসুন খাওয়া উচিত নয়।
রসুন কাটার পর খোলা জায়গায় ১৪ মিনিট রাখার পর কাঁচা খেতে পারেন অথবা তরকারিতে ব্যবহার করতে পারেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল কেন?
কারণ রসুনের মধ্যে জ্বালা সৃষ্টিকারী সালফোনিক অ্যসিড দ্রুত ভেঙে গিয়ে অ্যালিসিনে পরিণত হয়। প্রতি ৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড অন্তর গুণগতমানের বৃদ্ধি ঘটে। প্রতি ৭ মিনিটে একবার আর ১৪ মিনিটে দুইবার পরিবর্তন ঘটে। তাই রসুন কাটার পর ১৪ মিনিট খোলা জায়গায় রেখে তারপর ব্যবহার করতে পারেন।
এবার আমরা জেনে নেব রসুনের পুষ্টি সম্পর্কে।
রসুনের পুষ্টিগুণ:
- খাদ্যশক্তির
- শর্করা
- খাদ্য আঁশ
- প্রোটিন
- স্নেহ পদার্থ
- থায়ামিন
- নিয়াসিন
- ভিটামিন বি ৫
- ভিটামিন বি ৬
- ফোলেট
- ভিটামিন সি
- আয়রন
- ম্যাগনেসিয়াম
- ক্যালসিয়াম
- পটাশিয়াম
- ম্যাগনেসিয়াম
- ম্যাঙ্গানিজ
- ফসফরাস
- সোডিয়াম
- জিংক
প্রতি ১০০ গ্রাম রসুনের পুষ্টি উপাদান:
- খাদ্যশক্তির - ১৪৯ কিলো ক্যালরি
- শর্করা - ৩৩.০৬ গ্রাম
- খাদ্য আঁশ - ২.১ গ্রাম
- প্রোটিন - ৬.৩৬ গ্রাম
- স্নেহ পদার্থ - ০.৫ গ্রাম
- থায়ামিন - ০.২ মিলিগ্রাম
- নিয়াসিন - ০.৭ মিলিগ্রাম
- রিবোফ্লাভিন - ০.১১ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি ৫ - ০.৫৯৬ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি ৬ - ১.২৩৫ মিলিগ্রাম
- ফোলেট - ৩ মাইক্রগ্রাম
- ভিটামিন সি - ৩১.২ মিলিগ্রাম
- আয়রন - ১.৭ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম - ২৫ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম - ১৮১ মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম - ৪০১ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম - ২৫ মিলিগ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ - ১.৬৭২ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস - ১৫৩ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম - ১৭ মিলিগ্রাম
- জিংক - ১.১৬ মিলিগ্রাম
উপসংহার:
আজকে আমরা আমাদের এই আর্টিকেলটিতে জেনে নিলাম রসুন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে। এছাড়াও জেনে নিলাম প্রতিদিন সকালে এক কোয়াড রসুন খাওয়ার উপকারিতা, রসুনের মধ্যে পুষ্টিগুণ, রসুনের বিজ্ঞান সম্মত নাম ইত্যাদি সমস্ত রকম বিষয়ে জেনে নিলাম।
আপনাদের কাছে আমাদের এই আর্টিকেলটি বোধগম্য হয়েছে। যদি ভালো লাগে তো কমেন্টে জানান। ধন্যবাদ। সুস্থ থাকুন।