তেজপাতার উপকারিতা ও অপকারিতা - Bay Leaves - তেজপাতা আমাদের প্রতিটি রান্নাঘরেরই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। তেজপাতা হল একটি সুগন্ধিযুক্ত ঔষধি পাতা। তেজপাতা সুপের পোলাও এবং অন্যান্য সিদ্ধ জাতীয় খাবারের সুগন্ধ যোগ করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
প্রাচীন দিক ঐতিহ্যগত ঔষধ তৈরি করতে তেজপাতার ব্যবহার করা হতো। আজকে আমরা আমাদের এই আর্টিকেলটিতে জেনে নেব তেজ পাতা খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে।
তেজপাতার উপকারিতা ও অপকারিতা - Bay Leaves |
তেজপাতা কি কিভাবে খাওয়া যায়?
তেজপাতা কে আমরা বিভিন্নভাবে খাবারের সঙ্গে ব্যবহার করে খেয়ে থাকি। যেমন পায়েস, পোলাও, স্যুপ এবং অন্যান্য সিদ্ধ জাতীয় খাবারের সুগন্ধি যোগ করতে সাহায্য করে তেজপাতা।
তেজপাতা বিজ্ঞান সম্মত নাম কি?
তেজপাতার বিজ্ঞান সম্মত নাম হল Laurus nobilis ।
তেজপাতা গাছ |
তেজপাতা কেমন হয়?
তেজপাতা একটি সুগন্ধী যুক্ত পাতা। এটি লরাস পরিবারের অন্তর্গত। তেজপাতা প্রায় এক হাজার বছর ধরে খাবার এবং ঔষধের ব্যবহার হয়ে আসছে।
তেজপাতার প্রায় আড়াই হাজার প্রজাতি আছে। বেশিরভাগ তেজপাতা পাওয়া যায়,পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিক পাওয়া যায়।
তেজ পাতা সাধারণত মশলা অপরিহার্য তেল এবং ঐতিহ্যগত ঔষধে ব্যবহৃত হয়। তেজপাতার দুটি প্রজাতি আমরা ব্যবহার করে থাকি।
প্রথমটি হলো লরাস আজোরিকা এবং অন্যটি হলো এল. নোবিলিস। তেজপাতা কে শুকানোর পরে ব্যবহার করা হয়।
এবার আমরা জেনে নেব তেজপাতার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে।
তেজপাতার গুণাগুণ |
প্রতি ১০০ গ্রাম তেজপাতার পুষ্টিগুন:
- খাদ্য শক্তি ৩১৩ ক্যালোরি
- জল ৫.৪৪ গ্রাম
- প্রোটিন ৭.৬১ গ্রাম
- ফ্যাট ৮.৩৬ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট ৭৪.৯৭ গ্রাম
- ফাইবার ২৬.৩ গ্রাম
- আয়রন ৪৩.০ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম ৮৩৪ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন সি ৪৬.৫ মিলিগ্রাম
এবার আমরা জেনে নেব তেজ পাতার উপকারিতা সম্পর্কে।
তেজপাতার গুনাগুন উপকারিতা |
তেজপাতার উপকারিতা কি কি:
১. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সাহায্য করে তেজপাতা।
তেজপাতা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সাহায্য করে। রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে তেজপাতা।
২. দাঁতের জন্য উপকারিতা তেজপাতা।
তেজপাতা দাঁতের জন্য উপকারী একটি উপাদান। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তেজপাতার ডালগুলিতে কিছু উদ্বায়ী তেল থাকে। যেটা রক্ত প্রবাহকে উন্নত করতে সাহায্য করে।
এছাড়াও ভিটামিন সি আছে, যা মাড়ির টিস্যুকে শক্ত করতে সাহায্য করে। তেজপাতার ছাই দিয়ে ব্রাশ করলে মাড়ী শক্ত হয়। তেজপাতা মুখের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া বিনাশ করতে সাহায্য করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে তেজ পাতার অপরিহার্য তেল মুখের মধ্যে Staphylococcus aureus নামক ব্যাকটেরিয়া বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে ।
তেজপাতা তেলের উপকারিতা |
৩. শ্বাসতন্ত্রের জন্য তেজপাতার উপকারিতা।
তেজপাতা শ্বাস তন্ত্রে উন্নতিতে সাহায্য করে। কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জারের মতো স্বাসতন্ত্রের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে তেজপাতা।
তেজপাতার নির্যাস এর মধ্যে প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে তাই এটি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। তেজপাতার মধ্যে ইথানলিক নির্যাস এবং অন্যান্য কিছু বিশেষ কিছু যৌগ আছে, যা প্রদাহ বিরোধী এবং ব্যাথা নাশক হিসেবে কাজ করে।
এইসব কারণেই তেজপাতা শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ এবং উদ্ভূত রোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
৪. তেজপাতা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
ক্যান্সার নামক এই বিপদ জনক মরণ রোগটি নিয়ে বিজ্ঞান বিভিন্ন রকম গবেষণা করে চলেছে। কিন্তু এই রোগের সঠিক কোন চিকিৎসা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে হ্যাঁ, খাবারের যত্ন নেওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমে এই রোগটিকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। তেজপাতার মধ্যেও ক্যান্সার প্রতিরোধ উপাদান রয়েছে।
তেজপাতা ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধিতে বাঁধা সৃষ্টি করে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তেজপাতার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য আছে, তা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
আরো কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তেজপাতার নির্যাসে অ্যান্টিকার্সিনোজেনি প্রভাব আছে। যা স্তন ক্যান্সারের বৃদ্ধিতে বাঁধা দিতে পারে।
তেজপাতার গুনাগুন |
৫. ছত্রাক সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে তেজপাতা।
ছত্রাক সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে তেজপাতা সাহায্য করে। কারন তেজ পাতার মধ্যে আছে অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ। এটি খামির সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে কার্যকর। তেজপাতার তেল ত্বকের ছত্রাক সংক্রমনের জন্য ব্যবহার করা যেতে।
৬. ফোলা কমাতে তেজ পাতার উপকারিতা।
ব্যথা ও ফোলা রোগের জন্য তেজপাতার উপকারিতা আছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে তেজ পাতা COX-2 নামক এনজাইম এর কার্যকলাপ বাঁধা দিতে সাহায্য করে।
এই এনজাইমের জন্য শরীরে প্রদাহ বাড়তে পারে। পাতার মধ্যে উপস্থিত সিনিওল নামক একটি উপাদান প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
৭. তেজপাতা ক্ষত নিরাময়ে সহায়ক।
তেজপাতা ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তেজ পাতার নির্যাসের দানাদার টিস্যুর বিকাশের সাহায্য করতে পারে। অর্থাৎ সংযোগ করে টিসু যা ক্ষত নিরাময়ের সাহায্য করে।
৮. তেজপাতা কিডনি সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
তেজপাতার নির্যাস ঐতিহ্যগত ভাবে কিডনি ও মূত্রনালির পাথরের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে।
তেজপাতার নির্যার সরাসরি কিডনির পেশী শিথিল করতে সাহায্য করে। এর মধ্যে লরিক অ্যাসিড আছে, যা কিডনির সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে।
তেজ পাতৰ উপকাৰিতা |
৯. তেজপাতা ওজন কমাতে সহায়ক।
তেজপাতা ওজন কমাতে সাহায্য করে। তেজপাতা এমন একটি ভেষজ উপাদান যা খিদে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। তেজপাতা খাওয়ার পর অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ এড়াতে পারেন ও ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
১০. তেজপাতা কোলেস্টেরল এবং হার্টের জন্য উপকারী।
আমাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্র কমাতে তেজপাতা সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, তেজপাতার মধ্যে প্রাপ্ত ইথানল নির্যাস কোলেস্টেরলের সিরাম স্তর কমাতে সাহায্য করে।
এই নির্যাসটির মধ্যে কিছু ফেনোলিক যৌগ আছে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর কার্যকলাপের কারণে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। আর সেই সঙ্গে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্র বৃদ্ধি পায়।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ফলে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এইসব কারণের জন্য বলা হয়, তেজপাতা খেলে কোলেস্টেরল এবং হার্টের কার্যক্ষমতা সঠিক থাকে।
১১. চুলের জন্য তেজপাতার উপকারিতা।
তেজপাতার উপকার - তেজপাতা আমাদের চুলের জন্য খুবই উপকারী একটি উপাদান। চুলের গোড়াকে ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনের হাত থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। কারণ তেজপাতা অ্যান্টি ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ।
১২. ত্বকের জন্য তেজপাতার উপকারিতা।
তেজপাতা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী একটি উপাদান। তেজপাতার অপরিহার্য তেল প্রসাধনী শিল্পে, ক্রিম, পারফিউম এবং সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এটি ত্বকে গভীরভাবে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। কারণ এর মধ্যে আছে অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও তেজপাতাকে ত্বকের ফুসুরি, পোকামাকড় এবং মশা থেকে সুরক্ষা পেতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
১৩. তেজপাতার চায়ের উপকারিতা।
তেজপাতাকে কিভাবে ব্যবহার করবেন?
- তেজপাতা হল একটি মশলা। তাই এটি খাবারের স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- তেজপাতা পায়েস, খীর এই জাতীয় মিষ্টি খাবারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- তেজপাতার চায়ের উপকারিতা - অনেকে লিকার চায়ের তেজপাতা ব্যবহার করেন।
- চুলের জন্য এক কাপ জলে কিছু তেজ পাতার সিদ্ধ করে। মিনিট ১৫ পর জল থেকে পাতাগুলো বের করতে হবে তারপর ঠান্ডা হয়ে গেলে শ্যাম্পু করার পর। ওই জল চুলে এবং মাথার ত্বকে ভালোভাবে লাগাতে হবে। তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
- তেজপাতার তেলের উপকারিতা - ব্যথা এবং প্রদাহ থেকে মুক্তি পেতে তেজপাতার তেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ব্যথার স্থানে কয়েক ফোঁটা তেল লাগিয়ে হালকা করা ম্যাসাজ করতে হবে।
- ঠান্ডা এবং হজমের মত সমস্যার দূর করার জন্য তেজপাতা জলে সিদ্ধ করে পান করতে হবে।
তেজ পাতার অপকারিতা:
- গর্ভবস্থায় তেজপাতা বা এর সম্পূরক গ্রহণ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই তাই গর্ভাবস্থায় তেজপাতা ব্যবহার করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করবেন।
- ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য শুধুমাত্র একজন চিকিৎসকের তত্ত্ববধানে তেজ পাতা খাওয়া উচিত।
- তেজপাতা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র কে ধীর করার জন্য অ্যানেস্থেশিয়া ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। তাই অস্ত্রোপচারের কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে এবং পরে এর যে কোন পরিপূরক খাওয়া বন্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত।
- আবার তেজপাতার অসুবিধা আছে অ্যালার্জি। তেজপাতা থেকে তৈরি অপরিহার্য তে সংবেদনশীল তোকে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
তেজপাতা সম্পর্কে অন্যান্য কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর:
তেজপাতা গিলে খাওয়া কি ক্ষতিকর?
তেজপাতা পাউডার আকারেই খাওয়া উচিত। এটি গিলে খেয়ে ফেলার ফলে হজম হয় না। তেজপাতার কিনারা গুলি ধারালো যা শরীরে অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলিকে ক্ষতি করতে পারে এবং গলাতে আটকে যেতেও পারে।
তেজপাতা পুড়ে গেলে কি হবে?
তেজপাতা কি প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর?
হ্যাঁ তেজপাতা কুকুর, বিড়াল এবং ঘোড়াদের জন্য বিষাক্ত হতে পারে।
তেজপাতা কে অন্যান্য ভাষায় কি বলা হয়?
- তেজপাতাকে অন্যান্য ভাষা বলা হয়ে থাকে ইংরেজিতে Bay Leaf ।
- তেজপাতার বৈজ্ঞানিক নাম - বৈজ্ঞানিক ভাষায় Laurus azorica এবং L. নোবনিলিশ বলা হয়।
- হিন্দি এবং নেপালি ভাষায় তেজপাট্টা বলা হয়।
- আসামিয়া ভাষায় বলা হয় তেজ পাট।
- মারাঠি এবং সংস্কৃত তে বলা হয় তমাল পাত্র।
- তেলেগু ভাষাতে বলা হয় বগারা আকু।
- তামিলে বলা হয় পুনাই ইলাই।
- কন্নড় ভাষায় বলা হয় সিনেমোম।
তেজপাতা কি পোকামাকড় দূরে রাখতে সাহায্য করে?
হ্যাঁ তেজপাতা পোকামাকড় তাড়াতে সাহায্য করে।
তেজপাতা ঘুমাতে সাহায্য করতে পারে?
তেজপাতা ঘ্রাণ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। ফলে ভালো ঘুমানোর সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
তেজপাতা একটি মূত্রবর্ধক?
হ্যাঁ তেজপাতা হল একটি মূত্রবর্ধক। এটি প্রসবের মাধ্যমে শরীরের ক্ষতিকর পদার্থ বের করতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিসের রোগীরা কিভাবে তেজপাতা ব্যবহার করতে পারেন?
ডায়াবেটিসের রোগীরা তেজপাতা খেলে উপকার এবং অপকার দুটোই হতে পারে। তাই ডায়াবেটিসের রোগীরা শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শেই তেজপাতা খাওয়া উচিত।
উপসংহার:
আজকে আমরা আমাদের এই আর্টিকেলটিতে জেনে নিলাম তেজপাতা খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতার সম্পর্কে। আর জেনে নিলাম তেজপাতা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়? তেজপাতা কেমন হয়?
ইত্যাদি সমস্ত রকম বিষয় জেনে নিলাম। আশা করি আপনাদের কাছে আমাদের এই আর্টিকেলটি বোধগম্য হয়েছে। ভালো লাগলে আপনাদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন।
আর যদি কোন সমস্যা থাকে তাহলে কমেন্টে জানান। আর ধন্যবাদ জানাই বন্ধুদের কে যারা আমাদের এই আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছেন। সুস্থ থাকুন।