Palm fruit - তাল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা। Palm fruit benefits in Bengali for diabetes.তালগাছ আমাদের সকলের কাছেই খুবই পরিচিত একটি গাছ। তালগাছের উচ্চতা প্রায় ৩০ থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
তাল গাছের পাতার রং সবুজ দেখতে বড় বড় পাখার মতো গাছে, পাতার সংখ্যা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টি। অন্যান্য গাছের থেকে তাল গাছের পাতা আকারে অনেক বড় হয়। বৈশাখ মাসের সময় তালগাছে বাবুই পাখিতে বাসা বাঁধে।
তো আজকে আমরা আমাদের এই আর্টিকেলটিতে জেনে নেব তাল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে।
তাল গাছের বর্ণনা:
তাল গাছ হলো একটি শাখা প্রশাখাহীন একবীজপত্রী উদ্ভিদ। স্ত্রী, পুরুষ উভয় তাল গাছের ফুল আসে কিন্তু, ফল ধরে শুধুমাত্র স্ত্রী আছে। তাল গাছটির বয়স ১০ থেকে ১২ বছর হলে তবেই গাছে ফল আসতে শুরু হয়।
তাল কচি অবস্থায় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় কমলা ও কালচে বা কালো রঙের হয়ে থাকে। তাল কাঁচা, পাকা এবং তালের আঁটি মাটিতে ফেলে রাখার পর যখন অঙ্কুর বের হয় ওই তখন ওই আঁটি টিকে কেটে আঁটির মাঝ খানে সাদা অংশটি খাওয়া হয়।
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে কচি কাঁচা তাল খাওয়া হয়। কচি কাঁচা ফলের বীজটি জেলির মত নরম হয় এবং বরফের মতো সচ্ছ হয়। কচিকাঁচা তাল খেতে যেমন সুস্বাদু সে রকম সাদা মিষ্টি। কচি কাঁচা তালের মধ্যে থাকে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি। ভাদ্র আশ্বিন মাসে তাল পেকে যায়।
তখন পাকা তালের বিভিন্ন রকম খাবার বানিয়ে খাওয়া হয়। যেমন- তালের বড়া, পিঠা, তালের পায়েস, তালের ক্ষীর, তালের ফুলুরি, তালের রুটি, তালের লুচি ইত্যাদি বিভিন্ন রকম পাকা তালের তৈরি খাবার।
পাকা তালের তৈরি খাবার:
- পাকা তালের তৈরির রুটি।
- পাকা তালের তৈরি লুচি।
- পাকা তালের তৈরি বড়া।
- পাকা তালের তৈরি তালসত্ব।
- পাকা তালের তৈরি পায়েস।
- পাকা তালের তৈরি ক্ষীর।
- পাকা তালের তৈরি ফুলুরি।
তাল গাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার:
তাল গাছের কান্ড, পাতা, বাকোল, ফল সবকিছুই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উপকারী এবং দরকারী জিনিস।
- তাল গাছের কান্ড কেটে ঘরের খুঁটি তৈরি হয় খুবই শক্ত।
- তাল গাছের কান্ড থেকে বিভিন্ন রকম আসবাপত্র তৈরি হয়।
- তালের পাতা থেকে হাতপাখা, ঝুঁড়ি তৈরি হয়।
- আবার তালের পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনিও করা হয়।
- তাল গাছের ছাল দিয়ে দড়ি তৈরি করা হয়।
আবার তাল গাছে পুষ্প মঞ্জুরীর মাথা কেটে রস বের করা হয়, তারপর চিনি, ভিনেগার, তালমিছরি তৈরি করা হয়।
তালের বিজ্ঞান সম্মত নাম কি?
তালের বিজ্ঞান সম্মত নাম হল Broassus Flabellifer।
তালের ইংরেজি নাম কি?
তালের ইংরেজি নাম হল Plam Fruit।
এবার আমরা জেনে নেব তালের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে।
পাকা তালের পুষ্টিগুণ:
- খাদ্য শক্তি
- জলীয় অংশ
- ফ্যাট
- আমিষ
- শর্করা
- ক্যালসিয়াম
- খাদ্য আঁশ
- ফসফরাস
- থায়ামিন
- নিয়াসিন
- রিবোফ্লাভিন
- ভিটামিন সি
- আয়রন
প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তালের পুষ্টিগুণ:
- খাদ্যশক্তি - ৮৭ কিলো ক্যালরি
- জলীয় অংশ - ৭৭.৫ গ্রাম
- ফ্যাট - ০.১ গ্রাম
- আমিষ - ০.৮ গ্রাম
- শর্করা - ১০.৯ গ্রাম
- ক্যালসিয়াম - ২৭ মিলিগ্রাম
- খাদ্য আঁশ - ১ গ্রাম
- ফসফরাস - ৩০ মিলিগ্রাম
- থায়ামিন - ০.০৪ মিলিগ্রাম
- নিয়াসিন - ০.৩ মিলিগ্রাম
- রিবোফ্লাভিন - ০.০২ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন সি - ৫ মিলিগ্রাম
- আয়রন - ১ মিলিগ্রাম
কাঁচা তালের পুষ্টিগুণ:
- ভিটামিন এ
- ভিটামিন সি
- ভিটামিন বি
- কপার
- আয়রন
- পটাশিয়াম
- ফসফরাস
- জিংক
- ফাইবার
- ক্যালসিয়াম
- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট
- অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি
এবার আমরা জেনে নেবো তাল খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে।
তালের শাঁসের উপকারিতা:
১. তালের শাঁস জলের শূন্যতা দূর করে:
তাল যেহেতু গ্রীষ্মকালীন ফল তাই রোদের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং সময় তালের চাষ খাওয়ার মাধ্যমে অনেকটাই জলের শূন্যতা দূর করা সম্ভব হয়।
২. তালের শাঁস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:
শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হওয়া খুবই প্রয়োজন। আর তালের শাঁসের মধ্যে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
৩. তালের শাঁস খাবারের রুচি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে:
তালের শাঁস খাবারের রুচি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যেসব ব্যক্তি তালের শাঁস খেতে পছন্দ করেন তাদের মুখের রুচি অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। খাবারের রুচি বাড়াতে তালের শাঁস কার্যকরী উপাদান।
৪. তালের শাঁস লিভারের সুরক্ষা করে:
লিভারের সুরক্ষা করতে তালের শাঁস খুবই সাহায্যকারী উপাদান। তালের শাঁস খাওয়ার ফলে লিভারের বিভিন্ন রকম সমস্যা সমাধান হতে পারে।
৫. তালের শাঁস রক্তশূন্যতা দূর করে:
তালের শাঁস আমাদের শরীরে রক্ত শূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে। কারণ তালের শাঁসের মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন। যা আমাদের শরীরের রক্ত শূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে। তাই যে সব ব্যক্তি রক্তশূন্যতা বা রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন তাদের জন্য তালের শাঁস খাওয়া উপকারী।
৬. তালের শাঁস চোখের জন্য উপকারী:
তালের শাঁস চোখের জন্য উপকারী। কারণ তালের শাঁসের মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, যা রাত কানা রোগ দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও চোখের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি করতো সাহায্য করে।
৭. তালের শাঁস হাড় মজবুত রাখে:
তালের শাঁস হাড় মজবুত রক্তের সাহায্য করে। কারণ এর মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম, হাড় শক্ত রাখতে সাহায্য করে।
৮. তালের শাঁস দাঁত সুস্থ রাখে:
তালের শাঁস খাওয়ার ফলে আমাদের দাঁত সুস্থ থাকে। দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে তালের শাঁস। কারণ তালের শাঁসের মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম, যা দাঁতের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৯. তালের শাঁস স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে:
তালের শাঁস স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তাই যে সব ব্যক্তি বা বাচ্চাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল তাদের তালের শাঁস খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
১০. তালের শাঁস হজম শক্তি উন্নত করে:
তালের চাষ হজম শক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। কারণ তালের শাঁসের মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার। যা হজম শক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে।
পাকা তালের উপকারিতা:
১. পাকা তাল বুক ধরফর কমাতে পারে:
অনেক ব্যক্তির বুক ধরফর করার মতো সমস্যা আছে। সেই সব ব্যক্তি যদি পাকা তালের চার চামচ রসের সঙ্গে দুধ এর সাথে ভালো করে মিশিয়ে নেওয়ার পর, সকালে এবং বিকালে বেশ কয়েকদিন খাওয়ার ফলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
২. পাকা তাল পুরনো কাশি দূর করে:
অনেকদিন ধরে কাশি কমছে না, এই কাশি কমানোর একটি উপায় হল পাকা তাল। পাকা তালের চার চামচ রসের সঙ্গে দুধ ভালো ভাবে মিশিয়ে, তারপর কয়েকদিন খাওয়ার ফলে এই সমস্যা দূর হয়ে যেতে পারে।
৩. পাকা তাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে:
পাকা তাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। কারণ পাকা তালের মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। আর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সহায়ক।
৪. পাকা তাল দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে:
পাকা তাল দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। কারণ পাকা তালের মধ্যে আছে বিপুল পরিমাণে ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম। ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম আর ফসফরাস আমাদের দাঁত ও হারকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
৫. পাকা তাল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক:
পাকা তাল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। কারণ তালের মধ্যে আছে ফাইবার। যা হজমশক্তি উন্নত করে এবং মল নরম করতে সাহায্য করে। ফলে যে সব ব্যক্তি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য তাল উপকারী হতে পারে।
৬. পাকা তাল হজম শক্তি উন্নত করে:
পাকা তাল হজম শক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। কারণ পাকা তালের মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার। যা হজম শক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে।
এবার আমরা জেনে নেব তাল খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কে।
এবার আমরা জেনে নেব বিভিন্ন রকমের তালের তৈরি খাবার কিভাবে বানানো যায়।
৭. তাল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে:
তাল কিছুটা হলেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। অল্প পরিমাণে তাল খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হতে পারে।
পাকা তালের রেসিপি - Ripe Taal (Palm fruit) Recipe :
- তাল সত্ব - প্রথমে পাকা তালের আটি থেকে তালের শাঁস বারষ রসটা ভালো ভাবে বের করে নিতে হবে হাত দিয়ে। তারপর ওর সাথে ভালো ভাবে চিনি দিয়ে মিশিয়ে নেওয়ার পর, রোদের শুকিয়ে তৈরি হয় তালসত্ব।
- তালের পিঠা - তালের নির্যাসের সঙ্গে বা রসের সঙ্গে ডিম, চাল গুঁড়ো, চিনি এবং নারকেলের গুঁড়ো ভালো ভাবে মিশিয়ে তৈরি করা হয় তালের পিঠা।
- তালের জুস - প্রথমে ভালো করে পাকা তালের রসটা বের করে নিতে হবে। তারপর ওই রসের সাথে পরিমাণ মতো দুধ এবং চিনি দিয়ে ভালো ভাবে মিশিয়ে নেওয়ার পর তৈরি হয়ে যায় তালের জুস।
তালের অপকারিতা:
- যেসব ব্যক্তির ডায়াবেটিস কে ভুগছেন তাদের তালের পিঠা বেশি না খাওয়াই ভালো। তালের পিঠা বেশি খেলে তাদের ডায়াবেটিস বৃদ্ধি হতে পারে।
- যেসব ব্যক্তি কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন তাদের তালের পিঠা না খাওয়াই ভালো। তারা যদি বেশি পরিমাণে তালের পিঠা খায় তাহলে সেইসব ব্যক্তির কোলেস্ট্রেরল মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।
- যেসব ব্যক্তি হাই ব্লাড প্রেসারে ভুগছেন সেসব ব্যক্তি যদি ডিমের কুসুম ও দুধের সঙ্গে তাল বা তালের কোন জিনিস খান তাহলে তাদের ক্ষতি হবে।
- অতিরিক্ত মাত্রায় কাঁচা তাল খাওয়ার পর যদি জল খায় তাহলে পেট ব্যথা হতে পারে।
- অতিরিক্ত মাত্রায় তাল খাওয়ার ফলে বার বার পায়খানা, ডায়রিয়া, গ্যাস, অম্বল হতে পারে।
- তালে আবার অনেকের অ্যালার্জি থাকতে পারে। তাই সেসব ব্যক্তিদের তাল থেকে দূরে থাকাই ভালো।
উপসংহার:
আজকে আমরা আমাদের এই আর্টিকেলটিতে জেনে নিলাম তাল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে।
এছাড়াও জেনে নিলাম তালের বর্ণনা, তাল থেকে কি কি খাবার বানানো যায়, তালের বিজ্ঞান সম্মত নাম, তালের ইংরেজি নাম, তালের পুষ্টিগুণ, কাঁচা তাল এবং পাকা তাল খাওয়ার উপকারিতা, পাকা তালের রেসিপি ইত্যাদি সমস্ত রকম বিষয়ে।
আপনাদের কাছে আর্টিকেলটি বোঝার মত হয়েছে। ধন্যবাদ, আমাদের এই আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য। সুস্থ থাকুন।